উনি করতে চাচ্ছেন পাবলিক স্পিকিং কোর্স!
গুলশান থেকে ফিরছিলাম। একটু ভয়ে ভয়ে ছিলাম। শীঘ্রই নতুন কিছু শুরু করতে যাচ্ছি। হঠাৎ এক ফোন কল। অপরিচিত নম্বর। ধরার সাথে সাথেই শুনলাম — নাহিদ ভাই, আমাকে চিনেছেন? কন্ঠ শুনে আঁচ করতে পারলাম। তাই বললাম — চিনেছি। উনি বললেন — আমি আপনার পাবলিক স্পিকিং কোর্সে ভর্তি হতে চাই। শুনে আনি অবাক। উনি করতে চাচ্ছেন পাবলিক স্পিকিং কোর্স!
প্রথম ব্যাচের জন্য ছাত্র খুঁজছিলাম। পরিচিত সবার কাছে এক এক করে গিয়েছি। মোটামুটি সবাই পদ্ধতিটি পছন্দ করেছে, কিন্তু টানা ১৩ সপ্তাহের জন্য কোনো এক কোর্সের পেছনে তারা লেগে থাকতে চাচ্ছিল না। ১২ জন ছাত্র নিয়ে প্রথম ব্যাচ শুরু করতে চেয়েছিলাম। ৯-১০ জনের মত জোগাড় হয়েছে। আরও ২-৩ জন দরকার। প্রথম ক্লাস শুরু হতে মাত্র ৫ দিন বাকি। ঠিক তখনি এই ফোন কল।
ফোনটা যিনি করেছেন তার নাম আশরাফ (আসল নাম প্রকাশ করছি না)। আমার আগের অফিসের সহকর্মী। কর্পোরেট অ্যাফেয়ার্স ডিপার্টমেন্টে কাজ করেন। বয়স ৫০। আর এটাই হচ্ছে অবাক হওয়ার কারণ।
১. কোর্সের প্রচারণায় আমি অনেকের কাছে গিয়েছি, কিন্তু তার কাছে কখনোই যাইনি।
২. তিনি এ বয়সে পাবলিক স্পিকিং এর মতো শ্রমসাধ্য একটি স্কিল শিখতে এসেছেন, তাও আবার টানা ১৩ সপ্তাহ ধরে! যেখানে আমি অনেককেই বলতে শুনেছি — আমার বয়স ৪০ এর কাছাকাছি, এ বয়সে কি নতুন কিছু শিখতে পারব?
তার ফোনের সাথে সাথে সূরাহ আত্ব-ত্বলাকের ৩ নং আয়াতের কথা মনে পড়ে গেল..
ويَرْزُقْهُ مِنْ حَيْثُ لَا يَحْتَسِبُ وَمَنْ يَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ فَهُوَ حَسْبُهُ إِنَّ اللَّهَ بَالِغُ أَمْرِهِ قَدْ جَعَلَ اللَّهُ لِكُلِّ شَيْءٍ قَدْرًا
এবং তিনি তাকে এমন উৎস থেকে রিযক দিবেন যা সে কল্পনাও করতে পারবে না। আর যে আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করে, আল্লাহ তার জন্য যথেষ্ট। আল্লাহ তাঁর উদ্দেশ্য পূর্ণ করবেনই। নিশ্চয় আল্লাহ প্রত্যেক জিনিসের জন্য একটি সময়সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছেন
ব্যাচ শুরু হল। তিনি ক্লাসে এলেন। প্রথম ক্লাসেই বললেন,
আমি ইংরেজি ভালো বলতে পারি না। পাবলিক স্পিকিং বা প্রেজেন্টেশন আমি জীবনেও করিনি বা শিখিনি। মেয়ের স্কুলে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমাকে কথা বলতে বলে, কিন্তু সবসময়ই ভয়ে এড়িয়ে যাই। আমি কিছুই পারি না। তাই এখানে এসেছি শুধুমাত্র শেখার জন্য।
তার এই একাগ্রতার জন্য The Most Serious Student পুরষ্কার পান..
এরপর সপ্তাহের পর সপ্তাহ ক্লাস করেছেন। পুরো কোর্সে মোট ১১টি প্রেজেন্টেশন। সবগুলোই উনি দিয়েছেন। কোনো এক ক্লাসে উনি অসুস্থতার কারণে আসতে পারেননি। পরে আরেক ক্লাসে তিনি সেটাকে পূরণ করেছেন। প্রথম ক্লাসে উনি যখন প্রেজেন্টেশনে দাঁড়ান, বোঝাই যাচ্ছিল যে তার খুব কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু তিনি হাল ছাড়েননি। একের পর এক প্রেজেন্টেশন দিয়েছেন, ফিডব্যাকের উপর কাজ করেছেন এবং সময়ের সাথে সাথে মোটামুটি দক্ষ হয়ে উঠেছেন। উনি বাচ্চাদের ইংরেজি ভাষা শেখানোর উপর একটি প্রেজেন্টেশন দিয়েছিলেন, যা এখনও আমার মনে দাগ কেটে আছে। তিনি যখন শেষ প্রেজেন্টেশনে দাঁড়ান, তখন সবাই এক বাক্যে স্বীকার করে নেয় যে, আশরাফ ভাই শুধু পাবলিক স্পিকিংই শেখেননি, বরং তার চিন্তা-চেতনায়ও আমূল পরিবর্তন এসেছে। শেষ ক্লাসে ফিডব্যাকে তিনি বলেন যে, এখন থেকে আমার মেয়ের স্কুলে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কিছু বলতে বললে মনে হয় কিছু একটা বলতে পারব। তার এই একাগ্রতার জন্য The Most Serious Student পুরষ্কার পান।
আমার এ পর্যন্ত যা অভিজ্ঞতা হয়েছে তা থেকে বলতে পারি, আমাদের মাঝে কোনো কিছু শেখার বিরুদ্ধে নিচের বাঁধা দুটির কোনো একটি বা দুটিই একসাথে কাজ করে।
-
Feature Item 1
ডানিং-ক্রুগার ইফেক্ট (Dunning Kruger Effect)
-
Feature Item 1
লার্ন্ড হেল্পলেসনেস (Learned Helplessness)
ডানিং-ক্রগার ইফেক্ট কী?
প্রথমে আসি, ডানিং-ক্রগার ইফেক্ট কী?
বদর যুদ্ধে রসুলুল্লাহ (সা:) যখন বদর প্রান্তরে ক্যাম্প করেন, তাঁর সৈন্যবাহিনী ছিল ৩০০-৩১৭ জনের, ঘোড়া ছিল মাত্র দুটি, আর উট ছিল মাত্র ৭০টি (আর-রহীক্বুল মাখতুম বইয়ে দেওয়া সংখ্যা অনুযায়ী)। অন্যদিকে কুরাইশরা সংখ্যায় ছিল ১০০০ এর মতো। সোজা ৩ গুনেরও বেশি। তাদের ১০০ ঘোড়া ছিল এবং ছিল অসংখ্য উট। তাই বদর ছিল অসম এক যুদ্ধ এবং কাগজে-কলমে কুরাইশরা ছিল রেড-হট ফেবারিট। আমরা যদি ইতিহাস না জানতাম, তাহলে ধরেই নিতাম, কুরাইশরা হয়তো-বা অতি সহজেই জয়লাভ করেছে। কিন্ত বাস্তবে কী হয়েছিল? কুরাইশরা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। তাদের হাই প্রোফাইল নেতাদের মোটামুটি সবাই এ যুদ্ধে নিহত হয় এবং প্রায় ৭০ জন কুরাইশকে যুদ্ধবন্দী হিসেবে নেওয়া হয়। অন্যদিকে রসুলুল্লাহ (সা:) তাঁর বাহিনী থেকে মাত্র ১৪ জনকে হারান। এ যুদ্ধের মধ্য দিয়েই রসুলুল্লাহ (সা:) আরব বিশ্বে তাঁর সরব উপস্থিতির জানান দিয়েছিলেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে — কেন কুরাইশরা, এত বড় বাহিনী নিয়ে এসেও, রসুলুল্লাহ (সা:) ও তাঁর ছোট্ট এক সৈন্যশক্তির কাছে এভাবে পরাজিত হলো?
২০১১ সালের দিকে আমি ইসলাম শেখা শুরু করলে, আমার পূর্বের যত ভুল ধারণা ছিল সেগুলো ধীরে ধীরে পরিষ্কার হচ্ছিল, যা আমাকে আরও শিখতে উদ্বুদ্ধ করে। তবে এর সাথে একটি সমস্যাও যোগ হলো — আমি মানুষের মধ্যে কেবল ভুল খুঁজে পাচ্ছিলাম। আমার সাথে কোনো কিছু না মিললেই ধরে নিতাম যে, তার সঠিক জ্ঞান নেই এবং সে অজ্ঞ। অনেকের সাথে রীতিমত ঝগড়াও করেছি — আপনি যেটা জানেন ও যেভাবে জানেন, তা সঠিক না। তো এ নিয়ে প্রায়ই নিজের জন্য সমস্যা তৈরি করতাম। আলহামদুলিল্লাহ, আমি আমার সহকর্মীদের সহায়তায় সেই বিপজ্জনক ফাঁদ থেকে বের হতে পেরেছিলাম। তাদের প্রত্যেকেই আমার একেকজন শিক্ষক। আমি তাদের কাছ থেকে শিখেছি শুধু মাত্র কিছু তথ্য দিয়ে কারও ইসলাম পালন করাকে বিচার করার কোনো সুযোগ নেই। আমার জানা বা বোঝার মধ্যে ভুল থাকতে পারে। আবার একই বিষয়ের ভিন্ন ভিন্ন মতও থাকতে পারে। অথবা আমি কোনো কিছু জানলেও সেটাকে অন্যের কাছে তুলে ধরার উপযুক্ত একটি ভাষা আছে।
আবার প্রশ্ন আসে যে, ইসলাম তো আমাকে বিনয়ী হতে বলেছে, কিন্তু সেই ইসলাম সম্বন্ধে যখন দেখি কেউ ভুল জানছে বা করছে (অবশ্যই আমার মতে), সেক্ষেত্রে আমি বিনয়ী না হয়ে আরও দাম্ভিক হয়ে উঠেছিলাম, কেন?
ডেভিড ডানিং ও জাস্টিন ক্রুগার—দুই জন সোশ্যাল সাইকোলজিস্ট—ভিন্ন ভিন্ন ছাত্রের উপর ধারাবাহিকভাবে অনেকগুলো পরীক্ষা করেন এবং সবগুলো পরীক্ষা শেষে তারা একটি সাধারন প্রবণতা দেখতে পান, যা নিচের একটি সরলীকৃত গ্রাফের মাধ্যমে দেখানো হলো।
এ গ্রাফে আমরা দেখতে পাচ্ছি, কম দক্ষ বা অদক্ষ লোকদের কল্পনাপ্রসূত বা অনুভূত যে পারফর্মেন্স তা থেকে তাদের বাস্তব ফলাফল সবসময়ই কম। তাই তাঁদের মন্তব্য — কম দক্ষ বা অদক্ষ যারা আছে, তারা প্রায়সই তাদের নিজেদেরকে ও নিজেদের যোগ্যতাকে বা দক্ষতাকে অতিমূল্যায়ন করে। এ প্রবণতাকে নামকরন করা হয় ডানিং-ক্রুগার ইফেক্ট হিসেবে। ডেভিড ডানিং তাঁর Self-insight বইতে বলছেন — If you’re incompetent, you can’t know you’re incompetent … The skills you need to produce a right answer are exactly the skills you need to recognize what the right answer is.
যখন আপনি অযোগ্য, আপনি জানেন না — আপনি আসলে অযোগ্য। আপনি যে দক্ষতা দিয়ে কোনো সঠিক উত্তরকে বের করবেন, ঠিক একই ধরনের দক্ষতা দিয়ে আপনি ঐ সঠিক উত্তরটিকে চিনতে পারবেন।
তাই আমি যখন ইসলাম শিখছিলাম, আমি জানতাম না যে, আমি আসলে অদক্ষ এবং আমি যে অদক্ষ ছিলাম এটা বুঝতে আমার জানা দরকার ছিল দক্ষতা কাকে বলে এবং ইসলামের ব্যাপারে সঠিক ও সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি কী। সহকর্মীদের সংস্পর্শে এসে প্রথম বুঝতে পারি বা জানতে পারি যে, আমি অদক্ষ এবং তাদের কাছ থেকে সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির উপর বেশ ভালো ধারণা পাই।
ডানিং-ক্রুগার ইফেক্টকে উপরের গ্রাফ দিয়েও ব্যক্ত করা হয়। এখানে আমরা দেখতে পাচ্ছি — আমাদের আত্মবিশ্বাস অনেক অনেক বেশি থাকে যখন আমরা অদক্ষ বা কম দক্ষ। এরপর যখন আরও শিখতে থাকি, তখন আমাদের আত্মবিশ্বাস কমতে থাকে এবং তা কমতে কমতে সর্বনিম্ন স্থানে নেমে যায়। ঠিক এ পরিবৃত্তিতেই আমরা বিনয়ী হই। পরে ক্রমাগত শেখার ফলে আমাদের আত্মবিশ্বাস আবারও বাড়তে থাকে এবং ধীরে ধীরে আমরা দক্ষ হয়ে উঠি।
সুতরাং ইসলাম নিয়ে আমার অদক্ষতা আমাকে দাম্ভিক করে তুলেছিল এবং আমি ছিলাম ডানিং-ক্রুগার ইফেক্ট দিয়ে কলুষিত।
ঠিক তেমনি কুরাইশরাও জানত না, তারা অদক্ষ এবং তাই তারাও দাম্ভিক হয়ে উঠেছিল। ভেবেছিল তাদের সংখ্যাধিক্য দিয়েই তারা জয়লাভ করে ফেলবে। কুরাইশরা যখন বদর প্রান্তরে এগিয়ে যাচ্ছিল, তখন আবু সুফিয়ান তাদেরকে বার্তা পাঠিয়েছিল মক্কায় ফিরে যাওয়ার জন্য। কিন্তু আবু জাহল সদম্ভে সৈন্যবাহিনী নিয়ে বদরের দিকে এগিয়ে যায়। কারণ সে রসুলুল্লাহ (সা:) ও তাঁর বাহিনীকে শিক্ষা দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল এবং দেখাতে চেয়েছিল যে, কুরাইশরা তখনও অন্যদের চেয়ে শ্রেয়। তারা বদর প্রান্তরে তিন রাত থেকে উৎসবও করতে চেয়েছিল। কিন্তু অদক্ষতা ও দাম্ভিকতা তাদের বিনাশের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই তারাও ছিল ডানিং-ক্রুগার ইফেক্ট দ্বারা একেবারেই দূষিত।
ভিয়েতনাম যুদ্ধে জেনারেল ভো এন গুয়েন গিয়াপ একাই তাঁর ছোট্ট এক বাহিনী নিয়ে জাপানিদের, ফরাসিদের, আমেরিকানদের ও চীনাদের পরাজিত করেছিলেন এবং ভিয়েতনাম থেকে হটিয়ে দিয়েছিলেন। প্রশ্ন — এখানেও কী সমস্যা ছিল? সেই একই ডানিং-ক্রুগার ইফেক্ট। সবাই—জাপানি, ফরাসি, আমেরিকান ও চীনা—তাদের নিজেদের যোগ্যতাকে অনেক বড় করে দেখেছিল এবং ধরেই নিয়েছিল ভিয়েতনাম তাদের জন্য বড় কোনো সমস্যা না। ফলাফল আবারও শোচনীয় পরাজয়।
এ হচ্ছে ডানিং-ক্রুগার ইফেক্ট সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা। আপনারা যদি আরও জানতে চান, তাহলে ডেভিড ডানিং এর Self-insight বইটি পড়ুন।
লার্ন্ড হেল্পলেসনেস কী?
এবার আসি লার্ন্ড হেল্পলেসনেস প্রসঙ্গে। লার্ন্ড হেল্পলেসনেস বলতে আমরা কী বুঝি? লার্ন্ড হেল্পলেসনেসকে আমরা বাংলায় বলতে পারি — অধিগত অসহায়ত্ব। মানে আপনি অসহায়ত্ব শিখে গিয়েছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, মানুষ অসহায়ত্ব কীভাবে শেখে?
মার্টিন সেলিগম্যান সাইকোলজির উপর উচ্চতর গবেষণার জন্য ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভ্যানিয়াতে রিচার্ড সলোমনের গবেষণাগারে কাজ শুরু করেন। সেখানে ঢুকেই দেখতে পান যে, ব্রুস ওভারমিয়ার নামের একজন গ্র্যাজুয়েট ছাত্র বলছে —The dogs won’t do anything. Something’s wrong with them. So nobody can do any experiments.
যে কুকুরগুলোর কথা বলা হচ্ছে, সেগুলোকে দিনের পর দিন দুই ধরনের উত্তেজন (স্টিমুলেশন) দেওয়া হয়। প্রথমে একটি জোরে শব্দ করা হয় এবং এরপর তাদেরকে ছোট্ট বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হয়। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে, কুকুরগুলো মূল পরীক্ষায় যেন শব্দ শুনলেই বুঝতে পারে যে তাদেরকে শক দেওয়া হবে এবং পালানোর চেষ্টা করবে। এরপর মূল পরীক্ষা শুরু হয়। কুকুরগুলোকে একটি দুই কক্ষবিশিষ্ট সাটলবক্সে নেওয়া হয় এবং দুই কক্ষের মাঝখানে একটি ছোট্ট বিভাজক দেয়াল (ডিভাইডার) রাখা হয়। কুকুরগুলোকে প্রথম কক্ষে ছাড়া হলো এবং বৈদ্যুতিক শক শুরু হলো। কিন্তু দেখা গেল, কোনো কুকুরই শকওয়ালা প্রথম কক্ষ থেকে লাফিয়ে বিভাজক দেয়াল পাড় হয়ে শকবিহীন দ্বিতীয় কক্ষে গেল না। বরং তারা ঘেঙানি করতে করতে প্রথম কক্ষের মেঝেতেই নিস্তেজ হয়ে পড়ে ছিল। তারা কেবল লাফ দিয়ে দ্বিতীয় কক্ষে গেলেই শক থেকে বাঁচতে পারত কিন্ত তাদের কেউই এ কাজটি করল না। এর ফলে কুকুরদের নিয়ে যে শব্দের পরীক্ষা ছিল, তা শুরুই করা গেল না।
মার্টিন সেলিগম্যান ব্রুস ওভারমিয়ারকে মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন এবং কেন কুকুরগুলো এ রকম করল মনে মনে এর ব্যাখ্যাও পেয়ে গেলেন-
Accidentally, during the early part of the experiment, the dogs must have been taught to be helpless. That’s why they had given up. The tones had nothing to do with it. During Pavlovian conditioning they felt the shocks go on and off regardless of whether they struggled or jumped or barked or did nothing at all. They had concluded, or “learned,” that nothing they did mattered. So why try?
এরপর মার্টিন সেলিগম্যান আরেকজন গ্র্যাজুয়েট ছাত্র স্টিভেন মায়ারের সাথে মিলে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন কুকুরের গ্রুপকে নিয়ে আরেকটি পরীক্ষা শুরু করেন। প্রথম গ্রুপকে এমন শকের মধ্য দিয়ে নেওয়া হয় যেখানে চাইলেই কুকুরগুলো শক থেকে বের হয়ে আসতে পারবে এবং শক শুরু হওয়ার সাথে সাথে তারা সেটাই করে। দ্বিতীয় গ্রুপকেও ঠিক একই শক দেওয়া হয় কিন্তু এক্ষেত্রে চাইলেই তাদের শক থেকে বাঁচার কোনো উপায় নেই। তারা শক থেকে তখনি বাঁচতে পারবে যদি কেউ শকটি বন্ধ করে। তৃতীয় গ্রুপকে কোনো শকই দেওয়া হয় না। এরপর এ তিন গ্রুপের কুকুরগুলোকে এক এক করে আগের মতো মাঝখানে বিভাজকসহ দুই কক্ষের সাটলবক্সে নেওয়া হয় এবং বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হয়। সাথে সাথে প্রথম ও তৃতীয় গ্রুপের কুকুরগুলোর প্রত্যেকেই বিভাজক দেয়ালের উপর দিয়ে পাড় হয়ে নিজেদেরকে শক থেকে বাঁচায়। কিন্তু দ্বিতীয় গ্রুপের ৮টি কুকুরের মধ্যে ৬টিই শক থেকে বাঁচার কোনো চেষ্টাই করে না। এমনকি তারা দেখতে পাচ্ছে, মাঝখানে একটি দেয়াল আছে যেটা পাড় হলে হয়তো-বা কিছু হতেও পারে, তবুও তারা কোনো চেষ্টাই করে না। তারা ধরেই নিয়েছে, যা-ই করি না কেন, কোনো কিছুই কাজে আসবে না বা তাদেরকে শক থেকে বাঁচাতে পারবে না। তারা নিজেদেরকে একদমই অসহায় মনে করে। মার্টিন সেলিগম্যান এ অসহায়ত্বকে বলছেন — Learned Helplessness বা অধিগত অসহায়ত্ব। কারণ তারা কন্ডিশনিং এর ফলে অসহায়ত্ব শিখে ফেলেছে। তিনি এ ব্যাপারে তার Learned Optimism বইয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।
তাঁর মতে, এই লার্ন্ড হেল্পলেসনেস আমাদের সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। যেমন — কোনো হতদরিদ্র লোক যদি মনে করে, দারিদ্রের কষাঘাত থেকে তার কোনো মুক্তি নেই, তাহলে সে এই লার্ন্ড হেল্পলেসনেস দ্বারা আচ্ছন্ন। কোনো ছাত্র যদি মনে করে, সে অতটা প্রতিভাবান না এবং পড়াশোনা করেও তার কোনো লাভ নেই বা খুব বেশি কিছু সে করতে পারবে না, তাহলে তাকেও লার্ন্ড হেল্পলেসনেস পেয়ে বসেছে। আবার কেউ যদি মনে করে তাকে দিয়ে ব্যবসা হবে না, তাহলে সে-ও ঐ লার্ন্ড হেল্পলেসনেস দিয়ে কলুষিত। বিভিন্ন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে আমরা এই অসহায়ত্ব শিখে ফেলি। মা-বাবারা অনেক সময়ই তাদের বাচ্চাদের বলে ফেলেন — তোরে দিয়ে কিচ্ছু হবে না। এভাবে পুনরায় বলতে থাকলে তারা বিশ্বাস করতে শুরু করে যে, আসলেই তাদেরকে দিয়ে কিছুই হবে না এবং লার্ন্ড হেল্পলেসনেস তাদের মধ্যে ভর করে, যা সময়ের সাথে সাথে আরও বাড়তে থাকে।
সুতরাং ডানিং-ক্রুগার ইফেক্ট আপনাকে বুঝতেই দেবে না যে, আপনি এ মুহূর্তে অদক্ষ বা কম দক্ষ এবং আপনাকে দক্ষ হওয়ার জন্য আরও অনেক শিখতে হবে। আর লার্ন্ড হেল্পলেসনেস, আপনি চাইলেই ও পরিশ্রম করলেই যে কিছু একটা করতে পারবেন, তা থেকে আপনাকে বিরত রাখবে। তাই আপনি যদি কোনো কিছু শিখতে চান বা করতে চান, তাহলে অবশ্যই আপনাকে এ দুটি বাঁধা অতিক্রম করতে হবে। নতুবা আপনি কোনোকিছুই ভালোভাবে শিখতে পারবেন না বা করতে পারবেন না।
আমার পাবলিক স্পিকিং কোর্সে যে ১৫ জন কোর্স শেষ করেছে তাদের মধ্যে আশরাফ ভাই তার নিজস্ব সীমাবদ্ধতা থেকে সবচেয়ে ভালো শিখেছেন। বাকি ১৪ জনের মধ্যে ৬-৭ জন ছিল যারা প্রেজেন্টেশনে তার থেকে অনেক বেশি অভিজ্ঞ বা তার থেকে অনেক ভালো ইংরেজি বলে বা তারা নিয়মিত প্রেজেন্ট করে বা অনেক ভালো প্রতিষ্ঠান থেকে পড়াশোনা করে এসেছে। কিন্তু তারপরও তারা শেখার ক্ষেত্রে আশরাফ ভাইয়ের ধারে-কাছে আসতে পারেনি। কারণ ঐ দুটি অন্তরায় — ডানিং-ক্রুগার ইফেক্ট ও লার্ন্ড হেল্পলেসনেস। যে ৯ জন শেষ করতে পারেনি, তারাও ছিল এ দুটি বিষয় দিয়েই বাঁধাগ্রস্ত।
যারা ভালো শেখেনি বা শেষ করতে পারেনি, তাদের কয়েকটি কমেন্ট —
আশরাফ ভাই কেন অন্যদের চেয়ে ভালো শিখতে পারলেন?
-
আমি এ ব্যাচের অনেকের থেকে ভালো প্রেজেন্টেশন দেই। (ডা-ক্রু)
-
আমার প্রেজেন্টেশনে অত ভালো করার কোনো ইচ্ছে নেই। (ডা-ক্রু)
-
চাকরি ও পরিবার সামলে কোর্সের জন্য কোনো সময়ই বের করতে পারছি না। (লা-হে)
-
আমি চাইলেই অনেকের থেকে আরও ভালো প্রেজেন্ট করতে পারতাম। (ডা-ক্রু)
-
এতদিন হয়ে গেল, তবুও কেন জানি পুরো প্রক্রিয়াটাই ধরতে পারছি না। (লা-হে) এছাড়া আরও অনেক কমেন্ট।
আশরাফ ভাই ও আরও ৪-৫ জন যারা নিজস্ব সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়ে বেশ ভালো শিখেছে, তারা এ দুটি বাঁধা থেকে অনেকখানিই মুক্ত ছিল বা নিজেদেরকে তা থেকে দূরে রাখতে পেরেছিল। তাদের কয়েকটি কমেন্ট তুলে ধরছি —
-
এত লম্বা সময় ধরে কোর্স করব, তাই কিছু হলেও শিখব।
-
পারি, আর না পারি, ক্লাস ছাড়ব না, শেষ পর্যন্ত চালিয়ে যাব।
-
অফিসের ফাঁকে ও বাইরে সময় পেলেই এই ক্লাসের কাজ করি।
-
আর ইন্টারনেট থেকে কপি করব না। নিজে স্ক্রিপ্ট সাজিয়ে তারপর বলব।
সুতরাং কমেন্ট থেকেই দুই গ্রুপের চিন্তার ফারাক সহজেই বোঝা যাচ্ছে, যা অবশেষে দুই গ্রুপের পারফর্মেন্সের মধ্যেও ব্যবধান গড়ে তোলে।